সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ দু’পদ ঘোষণার প্রায় এক বছর কেটে যাচ্ছে। দীর্ঘ এ সময়ে পূর্নাঙ্গ কমিটি আলোর মুখ দেখেনি। এ নিয়ে নেতারা ক্রমশঃ অভ্যন্তরিণ বিরোধ ও গ্রুপিং দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। এরপরও জেলা আ’লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেমে নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বৈশি^ক করোনাকালে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এ সংগঠনটি। জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে আ’লীগ নেতা-কর্মীরা ছিলেন সোচ্চার। তাছাড়া প্রতিনিয়ত পালিত হচ্ছে দলীয় সকল কর্মসূচি। এরই মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ রাখতে জেলা আ’লীগের দায়িত্বশীলরা উপজেলা সফর করেন। আ’লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শফিক বলেন, জেলা আ’লীগে নেতৃত্ব নিয়ে মতানৈক্য আছে কিন্তু বিদ্রোহ নেই। তাদের কর্মকাণ্ডে আমরা সন্তুষ্ট। দলীয় সূত্রে জানা যায়, জেলা আ’লীগের সভাপতি এডভোকেট মোঃ লুৎফুর রহমান বয়সের ভারে ন্যুব্জ হওয়ায় সবক’টি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা সম্ভর হয়না। তবে, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মোঃ নাসির উদ্দিন খানের সরব তৎপরতা লক্ষণীয়। তাদের নেতৃত্বে দলের কার্যক্রম গতিশীল রয়েছে। নানা কারণে ক্ষুব্ধ দু’একজন ব্যতীত বিগত কমিটির অধিকাংশ নেতাদের উপস্থিতি ছাড়াও নতুন কমিটিতে স্থান পাচ্ছেন এমন নবাগত নেতাদেরও সাংগঠনিক কার্যক্রমের অগ্রভাগে দেখা যাচ্ছে। করোনাকালে জেলা সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির খান ত্রাণ সহায়তা নিয়ে নিম্ন আয়ের চাকুরিজীবীদের পাশাপাশি অসহায় মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। এমনকি রাতের আঁধারে অসংখ্য অসহায় মানুষের বাসা-বাড়িতে পৌছে দেন খাবার। বিভিন্ন উপজেলায় সংগঠন ও ব্যক্তির দেয়া সাহায্যকর্মেও অংশ নেন জেলা নেতারা। রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকার কথা জানিয়েছেন জেলা সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান।
এদিকে, যুক্তরাজ্য সংক্ষিপ্ত সফর শেষে গত মাসে দেশে ফিরেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলহাজ শফিকুর রহমান চৌধুরী। তিনিও বিশ^নাথ-বালাগঞ্জ-ওসমানীনগর উপজেলাসহ সিলেট নগরীর বিভিন্ন স্থানে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের আরো অনেক নেতা করোনাকালে মানুষের পাশে ছিলেন।
গত ৭ মার্চ সিলেট জেলা স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়াম কমপ্লেক্সে মুজিব জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষে ‘নব প্রজন্মের নব চেতনায় বঙ্গবন্ধু’ উৎসব থিম নিয়ে মাসব্যাপী জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। তাদের এ যুগপৎ কর্মসূচির দূরদর্শী ও সৃজনশীল অনুষ্ঠানমালা দলীয় নেতাকর্মীর পাশাপাশি সুধিজনের দৃষ্টি কাড়ে। জেলা ও কেন্দ্রের নেতারা এক কাতারে দাঁড়ান। সে সময় মহান মুক্তিযুদ্ধসহ নানাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য আওয়ামী লীগের সাবেক ত্যাগী নেতাদের স্বীকৃতি ও সম্মান জানানো হয়। অনুষ্ঠানের মাঝপথে করোনাভাইরাস বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রশাসনের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত ১৮ মার্চ মূলতবি করতে হয় অনুষ্ঠানমালার। জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের দু’সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে এডভোকেট নাসির উদ্দিন খান ও অধ্যাপক জাকির হোসেন মুজিব জন্ম শতবর্ষ-এর সম্পন্ন অনুষ্ঠানে যে প্রজ্ঞার সাক্ষর রাখেন তাতে সিলেট ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের প্রশংসা করেন।
দলীয় একাধিক নেতার সাথে আলাপকালে জানা যায়, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লুৎফুর রহমানের রাজনীতিতে প্রকাশ্যে কোন গ্রুপ নেই। আর সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মো. নাসির উদ্দিন খান ছাত্রলীগের পোড়খাওয়া সাবেক ছাত্র নেতা এবং অসংখ্য কর্মীগড়ার কারিগর। ক্লিন ইমেজের এ নেতার হাত ধরে ছাত্রাবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘তেলিহাওর গ্রুপ’। এ গ্রুপ থেকে অতীতে জেলা পর্যায়ে ছাত্রলীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের প্রায় সবক’টি কমিটিতে অনেক নেতা সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ গ্রুপে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, দখলবাজ ও ছিনতাইকারির অস্তিত্ব নেই বলে দাবি করছেন গ্রুপের নেতারা। এ কারণে দল ক্ষমতায় থাকলেও গত এক বছরে জেলা সাধারণ সম্পাদক নাসির খানের গায়ে লাগেনি কোন অপবাদের তকমা। তিনি গ্রুপ দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে ওঠে সবাইকে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছেন বলে মন্তব্য করেছেন তার শুভাকাক্সিক্ষরা ।
এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের বিগত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হুমায়ূন ইসলাম কামাল বলেন, সভাপতি ও সম্পাদকের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা রয়েছে। সভাপতি তেমন একটা সময় দিতে না পারলেও সম্পাদক নাসির খান শক্ত হাতে দলকে আগলে রেখেছেন। তিনি দুঃসময়ের ত্যাগী সাবেক ছাত্রনেতাদের মূল্যায়ন করেন এবং বিগত কমিটির সিনিয়র নেতাদের সাথে পরামর্শ করে দলীয় সিদ্ধান্ত নেন বলেও জানান হুমায়ূন কামাল। সাবেক শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক কবির উদ্দিন আহমদ বলেন, নাসির খানের রাজনৈতিক ম্যাকানিজমের কাছে দলের সকল গ্রুপ-উপগ্রুপ মিলে একাকার। এজন্য জেলা আ’লীগ দ্রুত তার লক্ষ্যপথে অগ্রসর হচ্ছে।
এদিকে, শীর্ষ দু’নেতা লুৎফুর-নাসিরের নেতৃত্বে জেলা আওয়ামী লীগের ঐক্য নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ, সম্প্রতি জেলা আ’লীগের প্রস্তাবিত কমিটি কেন্দ্রে জমা দেয়ার পর গ্রুপিং দ্বন্দ্ব কিংবা বিদ্রোহ প্রকাশ্য রূপ নেয়। দলের মূল স্রোতের বিপরীতে বিদ্রোহী হয়ে উঠেন জেলা আওয়ামী লীগের বিগত কমিটির উপ দপ্তর সম্পাদক আখতারুজ্জামান চৌধুরী জগলু ওরফে জগলু চৌধুরী ও মহানগর জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি এম. শাহরিয়ার কবির সেলিম। এরপর থেকে জগলু চৌধুরী ও তার অনুসারীদের জেলা আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছেনা।
এ প্রসঙ্গে জগলু চৌধুরী বলেন, এখন অনুপ্রবেশকারি, হাইব্রিড ও তৈলবাজদের ঠিকানা হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগ। ত্যাগীদের মূল্যায়ন না করায় সভাপতি ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আমিসহ অনেকেই কর্মসূচিতে যাচ্ছিনা। এ রকম একপেশে নেতৃত্ব অতীতে কখনো হয়নি। বিষয়টি কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অবগত করা হয়েছে। এসব ত্যাগীরা এখন প্রতিকারের আশায় রয়েছেন বলেও জানান জগলু চৌধুরী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা জানান, জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের পরপরই ষড়যন্ত্রের বীজ বুনা হয়েছে। এখন তা রাজনীতির মাঠে মঞ্চস্থ করা হচ্ছে। তাদের প্রত্যাশা, বর্তমান নেতৃত্ব একটু সহনশীল হয়ে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব, বিদ্রোহ কিংবা ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবেন।
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খান বলেন, জেলা আ’লীগ ঐক্যবদ্ধ এবং দলের কার্যক্রম গতিশীল রয়েছে। আমরা দলের নবীন-প্রবীণ সকল নেতাকর্মীকে সাথে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগে ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়। যারা বিভিন্ন সময়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে কিংবা অবাঞ্ছিত ছিল, তারাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তিনি ব্যক্তি হিংসা পরিহার করে সবাইকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও শেখ হাসিনার নির্দেশমতে রাজনীতি করার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সাখাওয়াত হোসেন শফিক বলেন, আমরা জেলা আ’লীগের কার্যক্রমে গতিশীল ও সৃজনশীলতা লক্ষ করেছি। এখানে নেতৃত্ব নিয়ে মতানৈক্য আছে কিন্তু বিদ্রোহ নেই। দলের স্বার্থে সবাইকে মিলেমিশে রাজনীতি করার আহ্বান জানান কেন্দ্রীয় এই নেতা। তিনি নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রথমে দল থেকে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। এজন্য বিতর্কিত কাউকে দলে রাখা হবে না।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ ডিসেম্বর সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে জেলায় সভাপতি পদে ৭ ও সাধারণ সম্পাদক ৯ জন প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু ওই অনুষ্ঠানে কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোট না দিয়ে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে পরামর্শ করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম চূড়ান্ত করা হয়। সে অনুযায়ী দলের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি জনাকীর্ণ সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এডভোকেট লুৎফুর রহমানকে সভাপতি ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খানকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করেন। এরপর কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সম্মেলন পরবর্তী হানা দেয় বৈশি^ক করোনাভাইরাস। এ সময়ে সারাদেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে।